বাচ্চাদের আংগুল চোষার কারন ও প্রতিকার

বাচ্চাদের আংগুল চোষার কারন ও প্রতিকার

বাচ্চাদের অনেক ধরনের বদ অভ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আঙ্গুল চোষা। আঙুল চোষাটা প্রায় প্রতিটি বাচ্চারই প্রকৃতিপ্রদত্ত অভ্যাস। এই অভ্যাসের ওপর ভর করেই বাচ্চারা জন্মের পর পরই মায়ের দুধ খেতে শেখে। এমন কি অনেক সময় ইমেজিং করে দেখা গেছে বাচ্চা মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেও বুড়ো আঙুল চোষে। জন্মের ৩ মাস বয়স থেকে শুরু হয়ে ৩ বছর পর্যন্ত এ অভ্যাস স্বাভাবিক এবং ৩ বছর থেকে ৫ বছরের মধ্যে এ অভ্যাস সাধারনত দূর হয়ে যায়।কিন্ত যদি ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যেও এ অভ্যাস না দূর হয় তাহলে বড় হয়েও অভ্যাসটা থেকে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা সৃস্ট্রি করতে পারে।
আংগুল চোষার কারন কি?
কোনো কারন ছাড়াই বাচ্চা প্রথমে আঙ্গুল চুষতে শুরু করে। পরে এটা করতে ভাল লাগে সেজন্যই করতে থাকে। গবেষনায় আনেক ইন্টারেস্ট্রিং কিছু কারন পাওয়া গিয়েছো, যেমনঃ বাচ্চার মধ্যে ভয় বা নার্ভাসনেস কাজ করলে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে, কোন কিছু একঘেয়েমী লাগলে, কোন কিছুতে রাগন্বিত হলে, অসুস্থতায় বা একাকিত্বতায় ভুগলে, এছাড়া বাচ্চা কারো দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য বা নিজেকে ঘুম পাড়াতে কিংবা ক্ষুধা লাগলেও বাচ্চা আঙ্গুল চোষার সাহায্য নিতে পারে।

কি কি সমস্যা হতে পারে :
পাচ বছর বয়সের পরেও বাচ্চার আংগুল চোষার অভ্যাস দূর না হলে আনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে।
১) উপরের পাটির দাঁত উঁচু এবং নিচের পাটির দাঁত ভিতরের দিকে হেলে পড়তে পারে।
২) দাতের পাশাপাশি উপরের চোয়াল সরু ও উচু হয়ে যেতে পারে।
৩। দাঁতে বা নখের নিচে ইনফেকশন হতে পারে।
৪) আঙ্গুলের চামড়া ক্ষয় হয়ে যেতে পারে বা আংগুল চিকন হয়ে যেতে পারে।
৫) সঠিক উচ্চারনে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে।
৬) ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস মুখে প্রবেশ করে পেটের পীড়া বা অন্য রোগ হতে পারে।
৭) স্কুল বা প্রিস্কুল শিশুরা ঘন ঘন আঙুল চুষলে সামাজিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে পারে।

কি করা যাবে নাঃ
১)সবার প্রথমেই যা করা উচিৎ নয় সেটা হলো, বিষয়টা করতে মানা করতে গিয়ে শিশুকে ঘনঘন বিরক্ত করা অথবা ক্রমাগত দোষারোপ করা বা মারধোর করা যাবে না। কারন, এটা সে মনের অজান্তে করছে। দোষারোপ করলে শিশু নিজেকে অপরাধি ভাববে।
২)শিশুর বয়স যা-ই হোক না কেন, তার অভ্যাসের ব্যাপারে তাকে তিরস্কার করা যাবে না বিশেষ করে আত্নীয় বা অন্য মানুষের উপস্থিতিতে। শিশুর মুখ থেকে আঙুল টেনে বের করার চেষ্টা করবেন না বরং শিশুকে বুঝিয়ে সে কাজটি তাকে দিয়েই করান।
৩)শিশুকে আঙ্গুল চোষার বিকল্প কিছু দেওয়া ঠিক হবে না। সেটা হবে একটা বাজে অভ্যাস দূর করার জন্য আরেকটা বাজে অভ্যাস ধরিয়ে দেওয়া।

৪)আজকাল এ অভ্যাস দূর করতে মুখে একধরনের চুষনী দিয়ে থাকেন, এটা শুধু মাত্র জার্নিতে অল্প ক্ষনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, দীর্ঘ দিন ব্যবহার এটিও আনেক ক্ষতির কারন হতে পারে।
প্রতিকার করবেন কিভাবেঃ
বাচ্চা একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে সভ্য ব্যবহার বা গুড ম্যানার্স শেখাতে শুরু করুন। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, বাড়ির লোক ও পাড়া পতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার, কোথাও বেড়াতে গেলে ব্যবহার, নিজের জিনিসপত্র সামলে রাখা ইত্যাদি সবকিছুই ভাল অভ্যাস বা গুড ম্যানার্স এ অভ্যস্থ করুন। নিজেকে বাচ্চার সামনে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরুন। নিজের স্বভাব, ব্যবহার বাচ্চাকে ফলো করতে বলুন। ওর ব্যবহারের কোথাও ঘাটতি থাকলে বকাঝকা না করে আপনার কথাটা খারাপ লেগেছে বা আপনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন সেটা বুঝিয়ে বলুন। শিশুকে এগুলো আয়ত্ত করালে সে নিজে থেকেই আংগুল চোষার বদ অভ্যাসটিও বন্ধ করতে পারবে, অন্যরা কেবল তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট করে যেতে হবে। তাকে বলতে হবে উৎসাহমূলক অনেক অনেক ভালো কথা, আন্তরিক আলিঙ্গন ও ভালোবাসা দিয়েই তার এ অভ্যাস পরিহারে সহয়তা করতে হবে। এ জন্যে কিছু কাজ করা যেতে পারে ।
১)পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং করতে হবেঃ শিশুকে জানাতে হবে যে, কী কারণে আঙ্গুল চোষা থামানো দরকার। তাকে বোঝাতে হবে যে, এটা তার দাঁত ও আঙ্গুলের ক্ষতি করতে পারে। তার বন্ধুরা এই বিষয়ে খেপাতেও পারে। কোন রকমের বকাঝকা বা শাস্তি এক্ষেত্রে কাজে আসবে না। শুধুমাত্র তাকে বুঝিয়ে যান অভ্যাসটি খারাপ এবং এর কারণে মানুষ তাকে অপছন্দ করতে পারে। নিজে বুঝিয়ে কাজ না হলে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে বা স্কুল টিচারের কাছে নিয়ে যান। অনেক সময় মা-বাবার চেয়ে ডাক্তার বা শিক্ষকের কথা বাচ্চারা বেশি শোনে।
২)শিশু কি কারণে আঙ্গুল চুষছে তা বুঝতে চেষ্টা করুন। উদাহরন স্বরুপ, শিশুর ক্ষিদে পেলে সে আঙ্গুল চুষতে পারে, তাই তাকে সময়মত তার খাবার খেতে দিন। এছাড়া অসুস্থতার জন্যেও শিশু এমন করতে পারে, তাই শিশুর অস্বস্তি ও অসুস্থতার ব্যাপারে নিশ্চিত হোন ভালোভাবে। বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ অথবা বিশেষ কোন পরিস্থিতি শিশুকে আঙুল খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। এমনকি ভয় থেকেও এই সমস্যা হতে পারে। ভাবুন, খুঁজে বের করুন, তাহলে আপনি সঠিক সমাধান দিতে পারবেন। এতে করে আপনার শিশু আত্নবিশ্বাসী আর কর্মক্ষম হবে এবং দেখবেন অভ্যাস পাল্টে গেছে।

৩)অন্য কোন কাজের মাধ্যমে শিশুর হাত দুটিকে ব্যস্ত রাখুন। আপনি আপনার সন্তানের সাথে বল দিয়ে খেলাধুলা করতে পারেন, তার সাথে ছবি আঁকতে পারেন, এভাবে তাকে ব্যস্ত রাখুন কথা ও খেলাচ্ছলে। যেহেতু হাত এবং আঙ্গুল সবই ব্যস্ত থাকবে তখন ওগুলো নিয়ে বাচ্চা ধীরে ধীরে আঙ্গুল চোষার কথা ভুলে যাবে।
৪)নিজেদের মধ্যে একটা পয়েন্ট দেওয়ার সিস্টেম চালু করতে পারেন। ভালো কাজের জন্য প্লাস পয়েন্ট, খারাপ কাজের জন্য মাইনাস পয়েন্ট। সপ্তাহ বা মাসের শেষে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট সংগৃহিত হলে ওর পছন্দ করা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান বা সিনেমা দেখান। এভাবে সে আঙুল চোষার অভ্যাস ছেড়ে দেবে।
৫)আজকাল বাবাদের থেকে মায়েরা আনেক বেশী ব্যস্ত থাকেন বিষেশ করে কর্মজিবী মায়েরা । নিজের কাজে খুব ব্যস্ত থাকলেও বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগটা যেন কখনোই ছিন্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। দিনের কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো একসঙ্গে পড়াশোনা বা একসঙ্গে খেলাধুলা করা, রাত্রে একসঙ্গে খেতে বসা, অফিস থেকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়া, এই ছোট ছোট অভ্যাসের মাধ্যমে সম্পর্কটা দৃঢ় হবে। ওর মধ্যে কোন ভয় বা নিরাপত্তার অভাব দেখা দিলে সেটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে ওকে আত্মবিশ্বাসী করে তুললে ওর বদ অভ্যাস নিজে থেকে কমে যাবে।
৬)বাচ্চার সঙ্গে পরিবারে সবাই মিলে একটা পার্টনারশিপ গড়ে তুলুন। তাকে বুঝিয়ে বলুন যে আংগুল চোষা একটা খারাপ অভ্যাস এবং এটাকে শত্রু ভেবে নিয়ে সবাই মিলে প্রতিরোধ করা জন্য অ্যাটাকিং প্ল্যান তৈরি করুন। সম্ভব হলে একান্নবর্তী পরিবারে থাকার চেস্টা করুন।
৭)বাচ্চা অভ্যাস টি ধাপে ধাপে পরিহার করতে পারলে তার জন্য তাকে অবশ্যই পুরস্কার দিন তবে কোনোভাবেই সেটা যেন ঘুষ না মনে হয়। গিফট যাই দিন সেটা যেন আপনার সাধ্যের মধ্যে হয় এবং বাচ্চার কাজে লাগে।
৮)আপনার শিশুর বুড়ো আঙুলে ছোট অ্যাডেসিভ টেপ পেঁচিয়ে লাগিয়ে রাখতে পারেন যাতে সে আঙুলটা মুখে পুরলেই এ ব্যাপারে সচেতন হয়। যদি এতেও কাজ না হয় তাহলে এই ব্যান্ডেজের ওপর সামান্য ভিনেগার লাগিয়ে রাখবেন। ভিনেগারের স্বাদ তাকে মনে করিয়ে দেবে, আঙুল চোষা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি আপনার শিশু ঘুমের মধ্যে আঙুল চোষে, এমনকি আঙুলে ব্যান্ডেজ নিয়েও চুষতে থাকে, তাহলে ঘুমের সময় তার হাতে গ্লাভস বা হাত মোজা পরিয়ে রাখুন।
৯) শিশুর আঙুল চোষার অভ্যাস বাদ দিতে খুব সহজ এবং কার্যকরী উপায় হচ্ছে নিম পাতা, করলার রস অথবা লেবুর রস বাচ্চাদের আঙ্গুলে মাখিয়ে দিতে পারেন। বর্তমানে শিশুর জন্য নিরাপদ এমন তিতা ওষুধ পাওয়া যায়। এগুলোতে তেতো উপাদান থাকে এবং তা শিশুর স্বাদ নিরূপক কোষগ্রন্থিতে আঘাত করে। ফলে আঙুল মুখে নিলেই শিশু তেতো স্বাদ পায় ।
১০) বাচ্চা অপুস্তিতে ভুগলেও অনেক সময় এই বাজে অভ্যাস তৈরি হয় তাই খাবার তালিকায় পুস্টিকর খাবার যেমন পর্যাপ্ত মাছ মাংস, সবুজ শাকসবজি, দুগ্ধজাতীয় খাবার, বিভিন্ন ধরনের ফল মুল , বাদাম ইত্যাদি রাখুন।
১১) সব কিছুওর পরেও যদি প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে বিনাদ্বিধায় কাউন্সিলর বা ডেন্ত্রিস্ট্রের সাহায্য নিন। অনেক সময় ডেন্টিস্টরা বাচ্চাদের মুখে ব্যবহারের জন্য ক্লিপ জাতীয় কিছু দিতে পারেন, তবে শুধুমাত্র কাউন্সেলিং করে অভ্যাস ত্যাগ করালে ফল ভালো পাওয়া যায়। নইলে বাচ্চা চিন্তিত বা ক্লান্ত হলে কিছু দিনের ব্যবধানে এই অভ্যাস আবার ফেরত আসতে পারে।

 

ডাঃ মোঃ হায়দার আলী খান
সিনিয়র কনসালটেন্ট (ডেন্টাল)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

Rate this post
Contact With Us
Send via WhatsApp
Scroll to Top